সবাই অবাক, সবাই ভাবে, ব্যাপারখানা
কি? ভয়কাতুরে মাহবুব আজ এমন সাহসী!
কাঁপুনি নেই কঁকানি নেই হেঁট করে নেই মাথা,
দুটি চোখে ভীরুতা নেই, জড়ানো নয় কথা।
তাঁকে কেঁচোই বলা যেত। রাতারাতি মানুষ হল সে? আহা, মানুষ মানেই ছেলেমানুষ, তার বয়স তো বেশি নয় , শক্ত মেরুদন্ড সহ মানুষ ছেলে হয়। সেই
কাহিনী বলি।
মাহবুব হল
অতি গরীব দুখী অনাথ ছেলে। এ জগতে কেউ নেই তার, পর সকলে। হায়রে কপাল, শুধুই গালাগালি। পান
থেকে চুন খসলেই
মার আথালি পাথালি। এই বয়সে এমন ভাগ্য যার, কেবল নিঠুর অত্যাচার। ভীরু তো সে হবেই।
তাকে ভরসা দেবে কে? ভালবাসায় ঘিরে রেখে কে-ই বা শেখাবে?
ভয়েই
বাড়ে ভয়। দরদ
পাওনা তার? তারও আছে হেসেখেলে বাঁচার অধিকার। তবু, এমনি মোদের মাহবুব ঝড়ের সাথে লড়ে ভয়কে গেল ভুলি। সেই কাহিনী বলি।
তখন গোধূলী, সূয্যি গেছে ডুবে। আঁধার নামে পূবে। রাতের আঁধার নয়কো শুধু, কালো মেঘের রাশি হু হু করে আসছে উঠে আকাশটাকে গ্রাসি, পাল্লা দিয়ে রাতের পাশাপাশি। এমন সময় কিনা, রসুল মিয়ার খেয়াল হল,
আজ বাড়ি থেকে পান তো হয়নি আনা।
নিজের দোষ, জেনেও
রসুল মিয়া ভাবে, চিরকালের দোষীর ঘাড়েই দোষ চাপাতে হবে। গর্জে ওঠে, “মাহবুব!! এদিক আয়।”
কানা চোখে কটমটিয়ে
চায়। বলে, “তোর এ বেয়াদবি মাপ না করা যায়। দৌড়ে গিয়ে বাড়ি থেকে পান নিয়ে আয়।” জোর বাতাসের
কলাপাতার থর থর দেখে মাহবুব
কাঁপে ভয়ে। বলে, “হুজুর যাই”। হঠাৎ কেঁদে আবার
বলে,”কেমন করে যাই, সঙ্গী যে কেউ নাই”। রসুল মিয়া রগচটা লোক।
এই কথা না শুনে, ছিঁড়ে ফেলার মত করে
মোচড় দিল কানে। ব্যঙ্গ করে
বলল তারে, “মোটর গাড়ি চাই?”
আর্ত
স্বরে মাহবুব
বলে,”যাচ্ছি, হুজুর যাই।”
রসুল মিয়ার দোকান হল ইস্টিশনের কাছে, নাম নিতাইপুর। বাড়ি হল মাঠ পেরিয়ে মাইল খানেক দূর। এই
দোকানে মাহবুব থাকে, খাটে এবং খায়।
আধপেটা বা সিকি পেটা যে দিন
যেমন পায়।
তারি জোরে রসুল মিয়া আজ, গায়ের জোরে পাঠায় তারে ফাঁকা মাঠের মাঝ।
নামছে যখন কালবোশেখির
ভয়াল কাল নিষ্ঠুর সাঁঝ।
আবছা আঁধার, তাতে আবার চোখ ভরেছে জলে, থেমে চোখ মোছে ছেঁড়া লুঙ্গী তুলে। তারপর ওঠে ঝড়, বাতাসের কী জোর! সে কী
তার হুল্লোড়! সুপারি গাছ ক’টি
বেঁকে নুয়ে পড়ে, কুর্ণিশ করে যেন ঝঞ্ঝায়। বড় গাছের ডাল লড়ে নিয়ে
ক্ষণকাল ভেঙ্গে পড়ে বাতাসের পাঞ্জায়। মেঘ গর্জন থামে, বৃষ্টিও সাথে নামে। ঝড়ে-জলে চিরকাল দোস্তি,
মিলেমিশে দুজনায় প্রচণ্ড ঝাপটায় দুনিয়ার সাথে করে কুস্তি। ছোট বুক ধুক ধুক মাহবুবের, বাঁচবার চেষ্টাও
বেকুবের। দিশেহারা
ছোটে সে, আছড়িয়ে পড়ে সে,
দাঁড়ালেই
ঝড় মারে
ধাক্কা। সারা গা ছড়ে যায়, হাড় ভাঙ্গা বেদনায় মনে হয় পেল বুঝি অক্কা। এমন সময় মাহবুব
ভাবে, মরব? মরতে হয় যদি মরব। যতক্ষন বেঁচে আছি ততক্ষণ
লড়ব। এরপর থেমে গেল
সেই ঝড়, মাহবুবের ভিতরে যা
চলছিল। বুক আর ধড়ফড় করে না, মাথা আর বনবন ঘোরে না। কেটে
গেল দিশেহারা ভাব যা তার ছিল। জামগাছটার গুড়ি জড়িয়ে ছিল ধরি। কোনমতে ছেড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি
হামাগুড়ি দিয়ে গেল সরি কিছুদূর।
পরক্ষণেই গাছটার মোটা ডাল আছড়ে পড়ল হুড়মুড়। ফাঁকায় না সরে গেলে থাকত গাছের তলে, মাহবুব হয়ে যেত চুর।
এবার সে দাঁড়ায় বুঝি, ঝড়ের মুখোমুখি। ভাবে,”মরব? বেশ মরতে হয় যদি মরব। যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ
তো লড়ব।” ঈষৎ বেঁকে পিছন ফিরে
মাহবুব বাড়ায় পা।
কালবৈশাখী ঝড়ের সাথে লড়ে মাহবুব গেল জিতে। ভয় আর
কখনো তাকে নাগাল পাবে না। সত্যি হল তাই। অবাক হবার এতে কিছু নাই। রসুল মিয়া চোখ রাঙ্গিয়ে তাকিয়ে
আছে দেখে ভয় হল না মাহবুবের। ভাবল, এ লোকটা কে? প্রকৃতির যে ভীষণ রূপ
মাহবুব দেখেছে, রসুল মিয়ার চোখরাঙ্গানি কি লাগে তার কাছে? কালবোশেখি ঝড়ের চেয়ে বেশি জোর রাখে কি রসুল মিয়ার পেশী? থাবা তুলে মারতে গেলে
তাই, বললে মাহবুব,”মারো যদি রক্ষা
তোমার নাই।” অত্যাচারী
চিরকালই ভীরু। যতই মোটা হোক না দেহ, সাহস বেজায় সরু। ভড়কে গিয়ে রসুল মিয়ার বড্ড হল রাগ। বলল
হেঁকে,”বেয়াদব, এক্ষুণি তুই ভাগ।” মাহবুব বলে,”যাই, ভাবছ বুঝি তোমার কাছে থাকতে আমি চাই? মস্ত বড় এই দুনিয়া, অনেক আছে ঠাঁই।” অবাক সবাই, সবাই ভাবে, ব্যাপারখানা
কী? ভয় কাতুরে মাহবুব আজ
এমন সাহসী!!