রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট, ২০২২

আমি নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমি নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি, 
তুমি অবসরমত বাসিয়ো।
নিশিদিন হেথায় বসে আছি,
তোমার যখন মনে পড়ে আসিয়ো ॥
আমি সারানিশি তোমা-লাগিয়া
রব বিরহশয়নে জাগিয়া--
তুমি নিমেষের তরে প্রভাতে
এসে মুখপানে চেয়ে হাসিয়ো ॥
তুমি চিরদিন মধুপবনে
চির- বিকশিত বনভবনে
যেয়ো মনোমত পথ ধরিয়া
তুমি নিজ সুখস্রোতে ভাসিয়ো।
যদি তার মাঝে পড়ি আসিয়া
তবে আমিও চলিব ভাসিয়া,
যদি দূরে পড়ি তাহে ক্ষতি কী--
মোর স্মৃতি মন হতে নাশিয়ো ॥

রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1296

রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1889

ami nishi din tomay

বৃহস্পতিবার, ৫ জুলাই, ২০১৮

হঠাৎ দেখা


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,
                 ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন।
      আগে ওকে বারবার দেখেছি
            লালরঙের শাড়িতে
                 দালিম ফুলের মতো রাঙা;
আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,
                 আঁচল তুলেছে মাথায়
      দোলনচাঁপার মতো চিকনগৌর মুখখানি ঘিরে।
            মনে হল, কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব
                     ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে,
                 যে দূরত্ব সর্ষেখেতের শেষ সীমানায়
                      শালবনের নীলাঞ্জনে।
                     থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা;
      চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে।
            হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে
                     আমাকে করলে নমস্কার।
            সমাজবিধির পথ গেল খুলে,
                      আলাপ করলেম শুরু --
            কেমন আছ, কেমন চলছে সংসার
                             ইত্যাদি।
      সে রইল জানলার বাইরের দিকে চেয়ে
যেন কাছের দিনের ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে।
      দিলে অত্যন্ত ছোটো দুটো-একটা জবাব,
            কোনোটা বা দিলেই না।
      বুঝিয়ে দিলে হাতের অস্থিরতায় --
            কেন এ-সব কথা,
      এর চেয়ে অনেক ভালো চুপ করে থাকা।
                 আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে
                       ওর সাথিদের সঙ্গে।
এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে।
            মনে হল কম সাহস নয়;
                 বসলুম ওর এক-বেঞ্চিতে।
গাড়ির আওয়াজের আড়ালে
                         বললে মৃদুস্বরে,
                 "কিছু মনে কোরো না,
            সময় কোথা সময় নষ্ট করবার।
      আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই;
               দূরে যাবে তুমি,
      দেখা হবে না আর কোনোদিনই।
    তাই যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে,
      শুনব তোমার মুখে।
            সত্য করে বলবে তো?
আমি বললেম, "বলব।"
      বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোল,
"আমাদের গেছে যে দিন
      একেবারেই কি গেছে,
            কিছুই কি নেই বাকি।"
একটুকু রইলেম চুপ করে;
      তারপর বললেম,
      "রাতের সব তারাই আছে
              দিনের আলোর গভীরে।"
খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেম না কি।
    ও বললে, "থাক্‌, এখন যাও ও দিকে।"
           সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে;
                          আমি চললেম একা।


  শান্তিনিকেতন, ২৪ জুন, ১৯৩৬

hotath dekha 

মঙ্গলবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৮

কণিকা


পরিচয়

দয়া বলে, ‘কে গো তুমি, মুখে নাহি কথা।’
অশ্রুভরা আঁখি বলে, ‘আমি কৃতজ্ঞতা।’


ক্ষুদ্রের দম্ভ

শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির,
‘লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির।’




 নম্রতা

কহিল কঞ্চির বেড়া, ওগো পিতামহ
বাঁশবন, নুয়ে কেন পড় অহরহ?
আমরা তোমারি বংশে ছোটো ছোটো ডাল,
তবু মাথা উঁচু করে থাকি চিরকাল।
বাঁশ কহে, ভেদ তাই ছোটোতে বড়োতে,
নত হই, ছোটো নাহি হই কোনোমতে।


ভিক্ষা ও উপার্জন
বসুমতি, কেন তুমি এতই কৃপণা,
কত খোঁড়াখুঁড়ি করি পাই শস্যকণা।
দিতে যদি হয় দে মা, প্রসন্ন সহাস—
কেন এ মাথার ঘাম পায়েতে বহাস।
বিনা চাষে শস্য দিলে কী তাহাতে ক্ষতি?
শুনিয়া ঈষৎ হাসি কন বসুমতী,
আমার গৌরব তাহে সামান্যই বাড়ে,
তোমার গৌরব তাহে নিতান্তই ছাড়ে।


উচ্চের প্রয়োজন
কহিল মনের খেদে মাঠ সমতল,
হাট ভ’রে দিই আমি কত শস্য ফল।
পর্বত দাঁড়ায়ে রন কী জানি কী কাজ,
পাষাণের সিংহাসনে তিনি মহারাজ।
বিধাতার অবিচার, কেন উঁচুনিচু
সে কথা বুঝিতে আমি নাহি পারি কিছু।
গিরি কহে, সব হলে সমভূমি-পারা
নামিত কি ঝরনার সুমঙ্গলধারা? 

পরের কর্মবিচার

নাক বলে, ‘কান কভু ঘ্রাণ নাহি করে,
রয়েছে কুণ্ডল দুটো পরিবার তরে।’
কান বলে, ‘কারো কথা নাহি শুনে নাক,
ঘুমোবার বেলা শুধু ছাড়ে হাঁকডাক।’

মঙ্গলবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৮

১৪০০ সাল

আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
      কৌতূহলভরে--
   আজি হতে শতবর্ষ পরে।
আজি নববসন্তের প্রভাতের আনন্দের
      লেশমাত্র ভাগ--
আজিকার কোনো ফুল, বিহঙ্গের কোনো গান,
   আজিকার কোনো রক্তরাগ
অনুরাগে সিক্ত করি পারিব না পাঠাইতে
      তোমাদের করে
   আজি হতে শতবর্ষ পরে।

তবু তুমি একবার খুলিয়া দক্ষিণদ্বার
      বসি বাতায়নে
সুদূর দিগন্তে চাহি কল্পনায় অবগাহি
      ভেবে দেখো মনে--
   একদিন শতবর্ষ আগে
চঞ্চল পুলকরাশি কোন্‌ স্বর্গ হতে ভাসি
   নিখিলের মর্মে আসি লাগে--
নবীন ফাল্গুনদিন সকল বন্ধনহীন
      উন্মত্ত অধীর--
উড়ায়ে চঞ্চল পাখা পুষ্পরেণুগন্ধমাখা
      দক্ষিণসমীর--
সহসা আসিয়া ত্বরা রাঙায়ে দিয়েছে ধরা
      যৌবনের রাগে
   তোমাদের শতবর্ষ আগে।
সেদিন উতলা প্রাণে, হৃদয় মগন গানে,
      কবি এক জাগে--
কত কথা পুষ্পপ্রায় বিকশি তুলিতে চায়
      কত অনুরাগে
   একদিন শতবর্ষ আগে।
   আজি হতে শতবর্ষ পরে
এখন করিছে গান সে কোন্‌ নূতন কবি
      তোমাদের ঘরে?
আজিকার বসন্তের আনন্দ-অভিবাদন
   পাঠায়ে দিলাম তাঁর করে।
আমার বসন্তগান তোমার বসন্তদিনে
   ধ্বনিত হউক ক্ষণতরে
হৃদয়স্পন্দনে তব ভ্রমরগুঞ্জনে নব
      পল্লবমর্মরে
   আজি হতে শতবর্ষ পরে।


  ২ ফাল্গুন, ১৩০২

বুধবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৭

আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি

রবীন্দ্র সংগীত
 
আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী !
ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে !
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।।
ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ,
দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরণ।
ওগো মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।।
তোমার মুক্তকেশের পুঞ্জ মেঘে লুকায় অশনি
তোমার আঁচল ঝলে আকাশতলে রৌদ্রবসনী!
ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।।
যখন অনাদরে চাই নি মুখে ভেবেছিলেম দুঃখিনী মা
আছে ভাঙা ঘরে একলা পড়ে, দুখের বুঝি নাইকো সীমা।
কোথা সে তোর দরিদ্র বেশ, কোথা সে তোর মলিন হাসি–
আকাশে আজ ছড়িয়ে গেল ওই চরণের দীপ্তিরাশি !
ওগো মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে ।।
আজি দুখের রাতে সুখের স্রোতে ভাসাও ধরণী–
তোমার অভয় বাজে হৃদয়মাঝে হৃদয়হরণী!
ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে !
তোমার দুয়ার আজি খুলে সোনার মন্দিরে।।

সোমবার, ২০ মার্চ, ২০১৭

আমার নিশীথরাতের বাদলধারা



আমার নিশীথরাতের বাদলধারা,

এসো হে গোপনে

আমার স্বপনলোকে দিশাহারা।।

ওগো অন্ধকারের অন্তরধন,

দাও ঢেকে মোর পরান মন–

আমি চাই নে তপন, চাই নে তারা।।

যখন সবাই মগন ঘুমের ঘোরে নিয়ো গো, নিয়ো গো,

আমার ঘুম নিয়ো গো হরণ করে।

একলা ঘরে চুপ চুপে এসো কেবল সুরের রূপে–

দিয়ো গো, দিয়ো গো,

আমার চোখের জলের দিয়ো সাড়া।।
amar nishito rater badol dhara

বুধবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়

সুরকারঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গীতিকারঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না-
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।
কান্নাহাসির বাঁধন তারা সইল না-
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।।
আমার প্রাণের গানের ভাষা
শিখবে তারা ছিল আশা-
উড়ে গেল, সকল কথা কইল না-
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।।
স্বপন দেখি, যেন তারা কার আশে
ফেরে আমার ভাঙা খাঁচার চার পাশে-
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।।
এত বেদন হয় কি ফাঁকি।
ওরা কি সব ছায়ার পাখি।
আকাশ-পারে কিছুই কি গো বইল না-
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।।

বৃহস্পতিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৬

গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ

গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ
আমার মন ভুলায় রে।
ওরে কার পানে মন হাত বাড়িয়ে
লুটিয়ে যায় ধুলায় রে।।ও যে আমায় ঘরের বাহির করে,
পায়ে-পায়ে পায়ে ধরে
মরি হায় হায় রে।
ও যে কেড়ে আমায় নিয়ে যায় রে;
যায় রে কোন্ চুলায় রে।
ও যে কোন্ বাঁকে কী ধন দেখাবে,
কোনখানে কী দায় ঠেকাবে–
কোথায় গিয়ে শেষ মেলে যে ভেবেই না কুলায় রে।।

শুক্রবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

এক গাঁয়ে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
.................
আমরা দু'জন একটি গাঁয়ে থাকি
সে আমাদের একটিমাত্র সুখ
তাদের গাছে গায়যে দোয়েল পাখি
তাহার গানে আমার নাচে বুক ।
তাহার দু'টি পালন করা ভেড়া
চরে বেড়ায় মোদের বটমূলে,
যদি ভাঙ্গে আমার ক্ষেতের বেড়া
কোলের পরে নেই তাহারে তুলে ।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ।

দুইটি পাড়ায় বড়ই কাছাকাছি
মাঝখানে শুধু একটি মাঠের ফাঁক
তাদের বনের অনেক মধু-মাছি
মোদের বনে বাঁধে মধুর চাক।
তাদের ঘাটের পূজার জবা মালা
ভেসে আসে মোদের বাঁধা ঘাটে
তাদের পাড়ার কুসুম ফুলের ডালা
বেচতে আসে মোদের পাড়ার হাটে ।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ।

আমাদের এই গ্রামের গলি পরে
আমের বোলে ভরে আমের বন
তাদের ক্ষেতে যখন তিসি ধরে
মোদের ক্ষেত তখন ফোটে শন ।
তাদের ছাদে যখন উঠে তারা
আমার ছাদে দখিন হাওয়া ছোটে
তাদের বনে ঝরে শ্রাবণ-ধারা
আমার বনে কদম ফোটে ওঠে ।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ।

মঙ্গলবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে

যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে॥
যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়—
তবে পরান খুলে
ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে॥
যদি সবাই ফিরে যায় , ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায়—
তবে পথের কাঁটা
ও তুই রক্তমাখা চরণতলে একলা দলো রে॥
যদি আলো না ধরে, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি ঝড়-বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে—
তবে বজ্রানলে
আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা জ্বলো রে॥
jodi tor daak shune keu na ashe
Click To Hear This Song

মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৬

নাট্যগীতি

প্রহরশেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস–
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ॥
এ সংসারের নিত্য খেলায় প্রতিদিনের প্রাণের মেলায়
বাটে ঘাটে হাজার লোকের হাস্য-পরিহাস–
মাঝখানে তার তোমার চোখে আমার সর্বনাশ॥
আমের বনে দোলা লাগে, মুকুল প’ড়ে ঝ’রে–
চিরকালের চেনা গন্ধ হাওয়ায় ওঠে ভ’রে ।
মঞ্জরিত শাখায় শাখায়, মউমাছিদের পাখায় পাখায়,
ক্ষণে ক্ষণে বসন্তদিন ফেলেছে নিশ্বাস–
মাঝখানে তার তোমার চোখে আমার সর্বনাশ॥

বুধবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৬

মেঘের কোলে রোদ হেসেছে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মেঘের কোলে রোদ হেসেছে,
বাদল গেছে টুটি। আহা, হাহা, হা।
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই,
আজ আমাদের ছুটি। আহা, হাহা, হা।।

কী করি আজ ভেবে না পাই,
পথ হারিয়ে কোন্‌ বনে যাই,
কোন্‌ মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি।
আহা, হাহা, হা।।

কেয়া-পাতার নৌকো গড়ে সাজিয়ে দেব ফুলে–
তালদিঘিতে ভাসিয়ে দেব, চলবে দুলে দুলে।
রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু চরাব আজ বাজিয়ে বেণু,
মাখব গায়ে ফুলের রেণু চাঁপার বনে লুটি।
আহা, হাহা, হা।।

বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন, ২০১৬

ছল



– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


তোমারে পাছে সহজে বুঝি তাই কি এত লীলার ছল –
বাহিরে যবে হাসির ছটা ভিতরে থাকে আঁখির জল।
বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব ছলনা –
যে কথা তুমি বলিতে চাও সে কথা তুমি বল না॥

তোমারে পাছে সহজে ধরি কিছুরই তব কিনারা নাই –
দশের দলে টানি গো পাছে বিরূপ তুমি, বিমুখ তাই।
বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব ছলনা –
যে পথে তুমি চলিতে চাও সে পথে তুমি চল না॥

সবার চেয়ে অধিক চাহ, তাই কি তুমি ফিরিয়া যাও –
হেলার ভরে খেলার মতো ভিক্ষাঝুলি ভাসায়ে দাও?
বুঝেছি আমি, বুঝেছি তব ছলনা –
সবার যাহে তৃপ্তি হল তোমার তাহে হল না॥

মঙ্গলবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৬

আমার হিয়ার মাঝে

আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাইনি তোমায়
দেখতে আমি পাইনি
বাহির পানে চোখ মেলেছি
বাহির পানে
আমার হৃদয় পানে
চাইনি আমি
আমার সকল ভালোবাসায়
সকল আঘাত, সকল আশায়
তুমি ছিলে আমার কাছে
তুমি ছিলে
আমি তোমার কাছে যাইনি
তুমি মোর আনন্দ হয়ে
ছিলে আমার খেলায়
আনন্দে তাই ভুলে ছিলেম
কেটেছে দিন হেলায়
গোপন রহি গভীর প্রানে
আমার দুঃখ সুখের গানে
সুর দিয়েছ তুমি , আমি তোমার গান তো গাই নি।।

আমার খেলা যখন ছিল

রবীন্দ্র সংগীত

আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে
তখন কে তুমি তা কে জানত
তখন ছিল না ভয়, ছিল না লাজ মনে
জীবন বহি যেত অশান্ত
খেলা যখন ছিল তোমার সনে
তুমি ভোরের বেলা ডাক দিয়েছ কত
যেনো আমার আপন সখার মত।
হেঁসে তোমার সাথে
ফিরেছিলেম ছুটে সেদিন
কত না মন বনান্ত
খেলা যখন ছিল তোমার সনে
ওগো সেদিন তুমি গাইতে যেসব গান
কোন ও অর্থ তাহার কে জানত
শুধু সঙ্গে তারই গাইত আমার প্রান
সদা নাচত হৃদয় অশান্ত।
হঠাৎ খেলার শেষে আজ কি দেখি ছবি
স্তব্দ আকাশ নিরব শশী রবি।
তোমার চরন পানে নয়ন করি নত
ঘুমুন তাড়িয়ে আছে একান্ত
খেলা যখন ছিল তোমার সনে
তখন কে তুমি তা কে জানত
তখন ছিল না ভয়, ছিল না লাজ মনে
জীবন বহি যেত অশান্ত
খেলা যখন ছিল তোমার সনে ।

মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

অকর্মার বিভ্রাট

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

------------------
লাঙল কাঁদিয়া বলে ছাড়ি দিয়ে গলা,
তুই কোথা হতে এলি ওরে ভাই ফলা?
যেদিন আমার সাথে তোরে দিল জুড়ি
সেই দিন হতে মোর মাথা-খোঁড়াখুঁড়ি।
ফলা কহে, ভালো ভাই, আমি যাই খসে,
দেখি তুমি কী আরামে থাক ঘরে ব’সে।
ফলাখানা টুটে গেল, হল্‌খানা তাই
খুশি হয়ে পড়ে থাকে, কোনো কর্ম নাই।
চাষা বলে, এ আপদ আর কেন রাখা,
এরে আজ চালা করে ধরাইব আখা।
হল্‌ বলে, ওরে ফলা, আয় ভাই ধেয়ে—
খাটুনি যে ভালো ছিল জ্বলুনির চেয়ে।

শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

প্রাণ


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে ,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই ।
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয় – মাঝে যদি স্থান পাই ।
ধরায় প্রাণের খেলা চিরতরঙ্গিত ,
বিরহ মিলন কত হাসি – অশ্রু – ময় ,
মানবের সুখে দুঃখে গাঁথিয়া সংগীত
যদি গো রচিতে পারি অমর – আলয় ।
তা যদি না পারি তবে বাঁচি যত কাল
তোমাদেরি মাঝখানে লভি যেন ঠাঁই ,
তোমরা তুলিবে বলে সকাল বিকাল
নব নব সংগীতের কুসুম ফুটাই ।
হাসিমুখে নিয়ো ফুল , তার পরে হায়
ফেলে দিয়ো ফুল , যদি সে ফুল শুকায় ।

বুধবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

সখী, ভাবনা কাহারে বলে



সখী, ভাবনা কাহারে বলে ।

সখী, যাতনা কাহারে বলে ।

তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’—

সখী, ভালোবাসা কারে কয় !

সে কি কেবলই যাতনাময় ।

সে কি কেবলই চোখের জল ? সে কি কেবলই দুখের শ্বাস ?

লোকে তবে করে কী সুখেরই তরে এমন দুখের আশ ।

আমার চোখে তো সকলই শোভন,

সকলই নবীন, সকলই বিমল,

সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন,

বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল— সকলই আমার মতো ।

তারা কেবলই হাসে, কেবলই গায়,

হাসিয়া খেলিয়া মরিতে চায়—

না জানে বেদন, না জানে রোদন, না জানে সাধের যাতনা যত ।

ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে, জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়,

হাসিতে হাসিতে আলোকসাগরে আকাশের তারা তেয়াগে কায় ।

আমার মতন সুখী কে আছে ।

আয় সখী, আয় আমার কাছে—

সুখী হৃদয়ের সুখের গান

শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ ।

প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল একদিন নয় হাসিবি তোরা—

একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা ॥

sokhi vabna kahare bole




শুক্রবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৬

মনে-পড়া



                       -  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু কখন খেলতে গিয়ে হঠাৎ অকারণে
একটা কি সুর গুনগুনিয়ে কানে আমার বাজে,
মায়ের কথা মিলায় যেন আমার খেলার মাঝে।
মা বুঝি গান গাইত আমার দোলনা ঠেলে ঠেলে-
মা গিয়েছে, যেতে যেতে গানটি গেছে ফেলে।
মাকে আমার পড়েনা মনে।
শুধু যখন আশ্বিনেতে ভোরে শিউলিবনে
শিশির-ভেজা হাওয়া বেয়ে ফুলের গন্ধ আসে
তখন কেন মায়ের কথা আমার মনে ভাসে।
কবে বুঝি আনত মা সেই ফুলের সাজি বয়ে-
পূজোর গন্ধ আসে যে তাই মায়ের গন্ধ হয়ে।
মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু যখন বসি গিয়ে শোবার ঘরের কোণে,
জানলা থেকে তাকাই দূরে নীল আকাশের দিকে-
মনে হয় মা আমার পানে চাইছে অনিমিখে।
কোলের পরে ধরে কবে দেখত আমায় চেয়ে,
সেই চাউনি রেখে গেছে সারা আকাশ ছেয়ে।

বৃহস্পতিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৫

ও আমার দেশের মাটি


ও আমার দেশের মাটি,

তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্বময়ীর,

তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।
তুমি মিশেছ মোর দেহের সনে

তুমি মিলেছ মোর প্রাণে মনে,

তোমার ওই শ্যামলবরন কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা।।
ওগো মা, তোমার কোলে জনম আমার,

মরণ তোমার বুকে।
তোমার ‘পরে খেলা আমার দুঃখে সুখে।
তুমি অন্ন মুখে তুলে দিলে,

তুমি শীতল জলে জুড়াইলে,

তুমি যে সকল-সহা সকল-বহা মাতার মাতা।।
ও মা, অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা–

তবু জানি নে-যে কী বা তোমায় দিয়েছি মা!
আমার জনম গেল বৃথা কাজে,

আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে–

তুমি বৃথা আমায় শক্তি দিলে শক্তিদাতা।।