কলিমউল্লাহ বলল- স্যার ভালো আছি । আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন স্যার ?
(তিনি তাকে চিনতে পারেন নি । চিনতে পারার কথাও না)
তারপরও হাসিমুখে বললেন- চিনতে পারবনা কেন? চিনেছি ।
(মিথ্যা বলার কারণ হলো তিনি অতীত অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, যতবার কোনো ছাত্রকে দেখে তিনি না চেনার কথা বলেছেন, ততবারই তারা ভয়ঙ্কর মনে কষ্ট পেয়েছে । এক ছাত্র তো কেঁদেই ফেলেছিল)
.
ধীরেন্দ্রনাথ রায় বললেন- বাবা, তোমার নামটা যেন কী ?
- কলিমউল্লাহ ।
- হ্যাঁ, তাই তো । কলিমউল্লাহ । এখন পরিষ্কার মনে পড়েছে । তুমি কি খাওয়াদাওয়া করেছ ?
- জি না স্যার ।
- এসো আমার সঙ্গে চারটা ভাত খাও । আয়োজন খুব সামান্য । ভাত, ডিম ভর্তা । ঘরে আরো ডিম আছে । তোমাকে ডিম ভেজে দেব। ঘরে এক কৌটা ভালো গাওয়া ঘি ছিল, কৌটাটা খুঁজে পাচ্ছি না..
.
কলিমউল্লাহ বলল- এখন খেতে পারব না । আপনার কাছে আমি একটা অতি জরুরী কাজে এসেছি ।
- জরুরী কাজটা কী ?
- মিলিটারির এক কর্নেল আপনার সাথে কথা বলতে চান ।
ধীরেন্দ্রনাথ রায় বিস্মিত হয়ে বললেন- আমার সাথে মিলিটারির কী কথা ?
- আমি জানি না । তবে স্যার আপনার ভয়ের কিছু নেই । আমি সঙ্গে আছি ।
.
ধীরেন্দ্রনাথ রায় বললেন- তুমি আমার কোন ব্যাচের ছাত্র বলো তো ?
- কথা বলে সময় নষ্ট করতে পারব না । মিটিংটা শেষ করে আসি, তারপর গল্প করব ।
- দুইটা মিনিট অপেক্ষা করো, ভাতটা খেয়ে নিই । আমি খুব ক্ষুধার্ত । সকালে নাশতা করিনি।
- ভাত খাবার জন্যে অপেক্ষা করার সময় নাই স্যার।
- তাহলে দাঁড়াও, পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে আসি । আমার সঙ্গে কি কথা বুঝলাম না । সে আমার ছাত্র না তো? করাচি ইউনাভার্সিটিতে আমি দু'বছর মাষ্টারি করেছি । প্রফেসর সালাম সাহেব সেখানে আমার কলিগ ছিলেন ।
কলিমউল্লাহ বলল- আপনার ছাত্র হবার সম্ভাবনা আছে । কর্নেল সাহেব যেভাবে বললেন "স্যারকে একটু নিয়ে আসো"... তাতে মনে হচ্ছে উনি আপনার ছাত্র ।
.
ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী গাড়িতে উঠে দেখলেন.. গাড়ি ভর্তি মানুষ । তারা সবাই চিন্তায় অস্থির । ধীরেন্দ্রনাথ রায় তাদের দিকে তাকিয়ে আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসলেন । ভুলে তিনি চশমা ফেলে এসেছেন বলে তাদের কাউকে চিনতে পারলেন না । চোখে চশমা থাকলে এদের অনেককেই তিনি চিনতেন । বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা সেই গাড়িতে বসেছিলেন । তাঁদের নিয়ে যাওয়া হবে বধ্যভূমিতে....
(জোছনা ও জননীর গল্প : হুমায়ূন আহমেদ)