বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

আয় আর সেবা দিন, তারপর আয়কর নিন

সব দেশের মানুষই কর ফাঁকি দিতে চায়। তা সত্ত্বেও অনেক দেশ নাগরিকদের কাছ থেকে প্রাপ্যটা ঠিকই আদায় করে নেয়। এর পাশাপাশি সবার জন্য ন্যূনতম আয় এবং নাগরিক সুবিধাও নিশ্চিত করে তারা। বাংলাদেশ সরকারেরও নেয়ার আগে দেয়া উচিত।

জার্মানিতে কর না দিয়ে থাকা মুশকিল। কর দিতে সবাই একরকম বাধ্য। প্রতিমাসে বেতনের প্রায় প্রায় অর্ধেক টাকা কেটে বাকি টাকার একটা হিসেব ধরিয়ে দেয়া হয়।

প্রায় চার বছর ধরে আমিও এই নিয়মের অধীন। ধরিয়ে দেয়া হিসেবে পরিষ্কার লেখা থাকে, প্রকৃত বেতন কত আর সব কাটাকুটির পরে পাবো কত। প্রথমে বেশ আফসোস হতো, ভাবতাম, ‘ইশ, এতগুলো টাকা কেটে নেয়!’

অবশ্য টাকাটা হঠাৎ কাটতে শুরু করেনি। নিয়োগপত্রেই বিষয়টির উল্লেখ ছিল। প্রতিমাসে কোন খাতে কত টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা থাকে। সেখানে স্বাস্থ্য বীমা, অবসর ভাতা, বেকার ভাতা, জার্মানির পূর্বাঞ্চলের উন্নয়ন কর-সহ সব খাতেরই উল্লেখ থাকে।

এতগুলো টাকা যে কেটে নিচ্ছে, তা নিয়ে কি মনে কোনো অসন্তোষ আছে? এখন আর একদমই নেই। না থাকার একটাই কারণ – পারিশ্রমিক থেকে যে টাকা কেটে নেয়া হয়, সময়মতো সমানুপাতিক বা তার চেয়ে বেশি হারে তা ফিরিয়েও দেয় জার্মান সরকার।

ব্যাপারটা বোঝাতে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শুধু দু’টো উদাহরণ দেবো।

২০১৪ সালে আমার একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। এমন বিপদ কখনো বলে-কয়ে আসে না। হঠাৎ ঝড়ের মতো এসে সব তছনছ করে দিয়ে যায়।

কিন্তু হয়ত জার্মানিতে ছিলাম বলেই ঝড়টা শরীর টের পেলেও, মনের ওপর বা পরিবারে তার তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। ডাক্তার রোগ নির্ণয়ের পরই অ্যাম্বুলেন্স ডেকেছিলেন। অ্যাম্বুলেন্সটাই ছিল মিনি হাসপাতাল। ছোট হাসপাতালে শুয়ে কয়েক মিনিটেই পৌঁছে যাই এই বন শহরেরই একটি হাসপাতালে।

দুপুরে অ্যাম্বুলেন্সে উঠলাম, বিকেল গড়ানোর আগেই অস্ত্রোপচার শেষ। কেউ একবার এসে বলেওনি, অপারেশনে কত টাকা লাগবে। বলার দরকারই পড়েনি।

ডাক্তার শুধু দেখেছেন আমার হেল্থ ইনস্যুরেন্স কার্ড। ঐ কার্ডই আমার হয়ে কথা বলেছে, বলেছে, ‘এই রোগী জার্মানিতে আসার পর থেকে তার কষ্টের উপার্জন দিয়ে এই দিনটির জন্য কিছু টাকা জমা করেছে। সুতরাং তাকে সারিয়ে তোলাই প্রথম ও শেষ দায়িত্ব। এর মাঝে কোনো কথা নেই। চিকিৎসার খরচ নিয়ে কোনো দরাদরির প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন একটাই– রোগীকে কত তাড়াতাড়ি সারিয়ে তোলা যাবে?’

সারিয়ে তুলতে প্রথমে দরকার ছিল অপারেশন। তা তারা কালবিলম্ব না করেই করেছেন। তারপর দরকার ছিল বাকি জীবন নিজেকে সুস্থ রাখার বিষয়ে রোগীকে সচেতন করা, কিছু প্রশিক্ষণ দেয়া। তা-ও তারা দিয়েছেন।

জার্মান সরকার বা চিকিৎসাসেবকদের কাছ থেকে এর বেশি কী চাইতে পারি আমি?

হার্ট অ্যাটাকের পরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, প্রবাসে আর একা থাকা নয়। তা পরিবার যদি নিয়ে আসি, চলব কীভাবে? বেতন থেকে যে এতগুলো টাকা কেটে নেয়, বাকি টাকায় সংসার চালানো যাবে?

সহকর্মীরা বললেন, ‘সে চিন্তা সরকারের৷ পরিবার এলে এত টাকা কাটবে না৷ কম কাটবে৷ ফলে আয় বেড়ে যাবে।’

সত্যিই তাই। পরিবারের সদস্যদের নাম এখানে নথিভুক্ত হওয়ার পরই মাস শেষে একটু বেশি টাকা ব্যাংকে জমা হতে লাগল। কিছুদিন পর টাকার অঙ্কটা আরেকটু বাড়ল।

কেন জানেন? আমার সন্তান যে স্কুলে যায়! তার একটা খরচ আছে না? সেই খরচের একটা অংশ দেয়ার দায়িত্ব আপনাআপনিই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে জার্মান সরকার। আমি শুধু নিয়ম মেনে জানিয়েছিলাম, সন্তান স্কুলে যাচ্ছে, লেখাপড়া করছে।

কর সব দেশের সব উপার্জনক্ষম নাগরিকেরই দেয়া উচিত। তবে জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের ন্যূনতম সামর্থ্য না থাকলে মানুষ কর দেবে কী করে? তাই সেদিকটা মাথায় রাখতে হবে৷ আর কর নেয়ার আগে যথেষ্ট নাগরিক সেবার নিশ্চয়তা দিতে হবে সরকারকে।
 

সূত্র: ডয়চে ভেলে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন